হস্তচালিত তাঁতের সংজ্ঞা (Definition of Hand loom )
মানবশক্তি দ্বারা অর্থাৎ হাত দ্বারা যে তাঁত চালনা করা হয় এবং কাপড় উৎপাদন করা হয় তাকে হস্তচালিত তাঁত বলে।
হস্তচালিত তাঁতের শ্রেণি বিন্যাস (Classificaion of Hand loom)
আমাদের দেশে সাধারণত তিন ধরনের হস্তচালিত তাঁত ব্যবহার হয়ে থাকে।
১. ফ্লাই শাটল লুম ( Fly shuttle loom)
২. প্রিমিটিভ লুম (Primitive loom)
৩. সেমি অটোমেটিক লুম (Semi automatic loom)
ফ্লাই শাটল লুম আবার দুই প্রকার
ক) ফ্লাই শাটল পিট লুম (Fly shuttle pit loom )
খ) ফ্লাই শাটল ফ্রেম লুম (Fly shuttle frame loom )
সেমি অটোমেটিক লুম বিভিন্ন ধরনের আছে । কিন্তু আমাদের দেশে নিম্নলিখিত হস্তচালিত তাঁত ব্যবহার হয়।
ক) চিত্তরঞ্জন তাঁত (Chittaranjan loom)
খ) স্যালভেশন আর্মি লুম (Salvaion army loom )
গ) হ্যাটার্সলি লুম (Hatersly loom )
১. ফ্লাই শাটল লুম (Fly shuttle loom)
ক) ফ্লাই শাটল পিট লুম (Fly shuttle pit loom )
সমতল ভূমিতে চারকোণায় চারটি বাঁশ বা কাঠের খুটি বসিয়ে পুরানো আমলের তাঁতের মতো মাটিতে গর্ত করে বসানো হয় । কাঠের ফ্রেমে ঝুলানো দক্তি (Sley) এবং তার দুই পার্শ্বের দুইটি শার্টল বক্স রেখে পিকার, হ্যান্ডেল ও পিকিং ব্যান্ডের সাহায্যে এক বাক্স হতে অন্য বাক্সে দ্রুত বেগে মাকু (Shuttle) চলাচল করে। যেহেতু তাঁতটি গর্ত করে বসানো হয় সেহেতু এই তাঁতকে গর্ত তাঁত বলে।
সমতল ভূমিতে চারপাশে চারটি বাঁশের বা কাঠের খুটি পুঁতে মান্ধাতার আমলের তাঁতের মতো মাটিতে গর্ত করে বসানো হয় । উক্ত ফ্রেমের উপর স্লে বাধা অবস্থায় ঝুলতে থাকে। সার্টেল বক্সে পিকার হ্যান্ডেল ও পিকিং ব্যান্ড থাকে যার সাহায্যে সার্টেল বক্স হতে অন্য বক্সে চলাচল করতে পারে ট্রেডেল গর্তের মধ্যে থাকে। তাঁতি গর্তে পা দিয়ে ট্রেডেল টিপে ঝাঁপ উঠানামা করায়। গর্ত করে তাঁত বসানোর ফলে টানা সুতা মাটির ঠাণ্ডা মেঝে থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ করতে পারে ফলে সুতা ছেড়ার হার কমে যায় ও টানা সুতা সর্বদা নরম থাকে বলে উৎপাদিত কাপড়ের মান ভালো হয়।
খ) ফ্লাই শাটল ফ্রেম লুম (Fly shuttle frame loom )
চারটি পায়া বিশিষ্ট ভারী কাঠের ফ্রেমের উপর বসানো হয়। এই ভাঁতকে ফ্রেম তাঁত বলে। ফ্রেম তাঁতে দক্তি (Sley), দুই পার্শ্বের দুইটি শাটল বক্স আছে। পিকার, হ্যান্ডেল ও পিকিং ব্যান্ডের সাহায্যে পিকিং করা হয় ।
এইটি পিট লুমের মতো একই প্রকার তাঁত, তবে এই প্রকার তাঁত শুধু ফ্রেমের উপর বসানো হয় বলে এই তাঁতকে ফ্রেম তাঁত বলা হয়।
চারটি ভারি কাঠের খুটির সাহায্যে ফ্রেম করে ফ্লাই সাটেল লুম তৈরি করা হয়। ফ্রেমের উপর শক্ত করে শে (Sley) ঝুলানো থাকে । যাতে এটা সহজেই সামনে পেছনে চলাচল করতে পারে। স্লে এর দুইপ্রান্তে দুইটি সাটল বক্স থাকে। যার মাধ্যমে সাটেল এক বক্স হতে অন্য বক্সে চলাচল করে। ফ্রেমের পেছনে টানা বিম ও সামনে ক্রস বিম ফ্রেমের পৃষ্ঠে চিত্রানুযায়ী বসানো থাকে। প্লে এর পেছনে ঝাপ ঝুলানো থাকে, যার নিচের দিক ট্রেডেলের সাথে যুক্ত। প্লে এর উপর তাঁতির হাত থাকে, যার সাহায্যে প্রতি পিক অন্তর তাঁতি স্নেকে সামনে পেছনে করতে পারে এবং ডান হাতে পিকিং হ্যান্ডেল থাকে যার মাধ্যমে সাটেল ডান বক্স থেকে বাম বক্সে এবং বাম বক্স থেকে ডান বক্সে চলাচল করানো হয়।
২. প্রিমিটিভ লুম (Primitive loom)
প্রাচীন তাঁতিগণ এক প্রকার দক্তিবিহীন তাঁতে একটি ঝুলানো ফ্রেমে শানা (Reed) আটকিয়ে মাকু হাতে ছুড়ে এক অদ্ভুত উপায়ে কাপড় বুনত । এই তাঁতকে প্রিমিটিভ লুম বা থ্রো শাটল লুম বলে ।
থ্রো সাটেল
থ্রো সাটেল সাধারণত কাঠের অথবা ধাতুর (Metal) তৈরি যা খুবই মসৃণ ও ভারী ফলে এটা খুব সহজেই কাপড়ের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলাচল করতে পারে। সাটেলটির মাঝখানে একটি ধাতুর তার ব্যবহার করা হয়। যা সাটেলের গর্ত বা ফাঁকে পার্ন সহজেই ধরে রাখতে পারে।
সাটেলটি এমন ডিজাইনের তৈরি যাতে টানা সুতাকে কোনরূপ ক্ষতি না করে খুব মসৃণভাবে কাপড়ের একপ্রাপ্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলাচল করতে পারে।
তাঁতির দক্ষতা ও সাটেলের মসৃণতার কারণে এ ধরনের সাটেল খুব সূক্ষ্ম কাপড় যেমন- সিল্ক, মসলিন, ইত্যাদির ক্ষেত্রেও ব্যবহার হয়ে থাকে।
সাটেলের গ্রহণযোগ্যতার কারণে খুব সাধারণ তাঁতেও খুব উন্নতমানের কাপড় তৈরি করা সম্ভব।
ইন্ডিয়ান হস্তচালিত তাঁত
খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০০ থেকে ৬০০০ বছর পূর্ব থেকে পাক ভারত উপমহাদেশে এই হস্তচালিত তাঁত ব্যবহার হয়ে আসছে। মাটিতে গর্ত করে ৪টি খুটি, ঝাঁপ, শানা, মতিকাঠি, লিজরড ইত্যাদির সাহায্যে কাপড় বোনা হতো। চারটি খুবি তাঁতের চারপাশে রেখে ফ্রেম তৈরি করে তাঁতের রূপ দেওয়া হতো। এ তাঁতটি ইন্ডিয়ান হস্তচালিত তাঁত বলে পরিচিত। একে পিট লুম বা থ্রো সাটেল পিট লুমও বলা হয়।
এ পদ্ধতিতে হাত দ্বারা ছুড়ে সাটেল এক প্রান্তের সেলভেজ হতে অন্য প্রান্তের সেলভেজ পর্যন্ত নেওয়া হয় এবং গর্তের মধ্যে পা দিয়ে টিপে বা চেপে দুইসারি টানা সুতার মাঝে সেড গঠন করে। এ ধরনের তাঁত মসলিন ও সিল্ক কাপড় তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহার হয় । চিত্রে একটি ইন্ডিয়ান হুম দেখানো হলো ।
A. টানা সুতা, B ও B দু'টি ঝাঁপ, C সাপোর্টিং বার এর মাধ্যমে ঝুলানো থাকে। ঝাঁপ দুইটি D ও D দুইটি হিল্ড হর্স এর সাথে যুক্ত থাকে। E ও F যথাক্রমে কাপড় ও টানা সুতা জড়ানোর জন্য লুম ফ্রেমে যুক্ত থাকে। দুইটি বাশের তৈরি ট্রেডল G ও G/ গর্তের মধ্যে অবস্থিত যার সাথে কার্ড বা দড়ি দ্বারা ঝাঁপের সাথে সংযুক্ত পা দ্বারা ট্রেডল চেপে সেড গঠন করা হয়। সমস্ত অংশটি একটি বাঁশের তৈরি (বর্তমানে কাঠের) ফ্রেমে ঝুলনো থাকে।
৩. সেমি অটোমেটিক লুম (Semi automatic loom)
A ও B = ঝাঁপ C ও D = ট্রেডেল EF = হিল্ড হর্স G = শানা H = দক্তির পাখা P = ফ্রেমের সম্মুখ অংশ N = ব্যাক রেস্ট M = টানা বিম S = ক্লথ বিম
ক) চিত্তরঞ্জন তাঁত (Chittaranjan loom)
দক্তি ঠেলার সংগে সংগে একসেট পিনিয়ন ও হুইন দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে টেক আপ হতে থাকে। পাশা পাশি লেট অফ ও টেনশনের কারণে স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় । বাকি কাজে সেডিং দ্বারা পিকিং হ্যান্ডেল দ্বারা ও বিটিং আপ দক্ষি টেনে অর্থাৎ হাত দ্বারা সম্পন্ন হয়। এই জন্য এই তাঁতকে সেমি অটোমেটিক তাঁত বলে। এটি লৌহ ও কাষ্ঠ নির্মিত । অন্যান্য হস্তচালিত তাঁত অপেক্ষা এর উৎপাদন অনেক বেশি।
খ) স্যালভেশন আর্মি হুম (Salvation army loom)
প্যাডেল টিপে দক্তি (Sley) সামনের দিকে টানলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেডিং, পিকিং, লেট অফ ও টেক আপ হতে থাকে। এজন্য এ প্রকারের তাঁতকে সেমিঅটোমেটিক হস্তচালিত তাঁত বলা হয়ে থাকে। এ প্রকার তাতে ছবি ও জ্যাকার্ড সংযোগ দিয়ে কাপড়ে অলংকৃত ডিজাইন প্রস্তুত করা সম্ভব ।
গ) হ্যাটার্সলি লুম (Hatersly loom)
এই তাঁতে লেট অফ, পিক আপ ও পিকিং স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় বলে এই লুমকে সেমি অটোমেটিক লুম বলা হয় । এটি লৌহ নির্মিত সাধারণ হস্তচালিত তাঁত অপেক্ষা তিন চার গুণ বেশি উৎপাদন দিতে পারে। এটি অনেকটা শক্তিচালিত তাঁতের অনুরূপ ।
তাঁত হতে কাপড় প্রস্তুতি
উইভার বীম (1) হতে টানা সুতাগুলো ব্যাক রেস্ট (2,3) এর উপর দিয়ে প্রবেশ করে। লিজ রড ( 4,5) টানা সুতাগুলোকে সোজা ও সমান্তরাল রাখে। অতপর টানা সুতাগুলোকে কাপড়ের ডিজাইন অনুযায়ী হিল্ড শ্যাফট (6,7) এর চক্ষুর ভিতর দিয়ে নেয়া হয়। টেপেট/ডবি/জ্যাকার্ড মেকানিজমের মাধ্যমে ডিজাইন অনুযায়ী হিল্ড শ্যাফ্টগুলো উঠানামা করে। হিল্ড শ্যাফটে অবস্থিত টানা সুতাগুলোকে রিড (8) এর ডেন্টের ফাকের মধ্যে প্রবেশ করানো হয়। তাঁত চালু করার সাথে সাথে মাকু (Shuttle) শ্যাড (Shed) এর ভিতর আসা যাওয়া করে অর্থাৎ পিকিং সম্পন্ন হয়। পিকিং এর ফলে কাপড় উৎপন্ন হয়। বিটিং মেকানিজমের মাধ্যমে উৎপন্ন কাপড়কে ফেল অব দি ক্লথ (Fell of the Cloth) এর সাথে মিলিয়ে দেয়া হয়। উৎপন্ন কাপড় ফ্রন্ট রেস্ট (11) এর উপর দিয়ে ইমারী রোলার (12) হয়ে ক্লথ রোলারে (14) জড়ায়। এভাবে তাঁতের সাহায্যে কাপড় উৎপন্ন হয়।
অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. মানব শক্তি দ্বারা কোন যন্ত্রের সাহায্যে কাপড় উৎপাদন করা হয় ?
২. ফ্লাই সাটেল লুম কত প্রকার ও কি কি ?
৩. প্রিমিটিভ লুমের সংজ্ঞা দাও ।
৪. ফ্রেম তাঁতকে কেন ফ্রেম তাঁত বলা হয় ?
৫. কাপড় বুননের সময় টানা সুতা মাটির ঠাণ্ডা মেঝ থেকে আর্দ্রতা গ্রহণ করলে কী সুবিধা হয় ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন
১. কয়েকটি সেমি অটোমেটিক লুমের নাম লেখ ।
২. থ্রো সাটেল লুমের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও ।
রচনামূলক প্রশ্ন
১। ইন্ডিয়ান হস্তচালিত তাঁতের বর্ণনা দাও।
২। চিত্র সহ ফ্লাই সাটেল লুমের বর্ণনা দাও।
আরও দেখুন...